নুর উদ্দিন, সুনামগঞ্জ : দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে থাকা সাবেক এম এন এ, মুক্তিযুদ্ধের-৫নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা মরহুম আব্দুল হকের সমাধিস্থল অবশেষে স্থানান্তর হয়েছে।
মঙ্গলবার ছাতকের কোর্ট পয়েন্ট থেকে কবরের মাঠি নিয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলার হকনগরে (৫নং সেক্টর) এ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার সমাধিস্থল স্থাপন করা হয়। এর আগে ছাতকে তার কফিনে সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিক, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, উপজেলা আওয়ামীলীগ ও অঙ্গসংগঠন, মরহুমের পরিবারবর্গসহ সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।
দোয়ারাবাজারের হক নগরে রাষ্ট্রীয় সম্মানে সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিক, ছাতক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান আবু সাদাত লাহিন, দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীরপ্রতীক, বর্তমান চেয়ারম্যান ডাঃ আব্দুর রহিম, মরহুমের পরিবারবর্গের মধ্যে মরহুমের ভাতিজা মাওলানা আব্দুস শহিদ, আবুল আহসান শিহাব, প্রপৌত্র সিলেট মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি এম রশীদ আহমদসহ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর সিলেট সার্কিট হাউজে সংগ্রাম কমিটির সভা থেকে প্রাইভেট গাড়ি যোগে সুনামগঞ্জে ফেরার পথে সিলেট-সুনামগঞ্জ রোডে টুকেরবাজার এলাকায় মর্মান্তিক এক সড়ক দূর্ঘটনায় এমএনএ আব্দুল হক চলে যান না ফেরার দেশে। ২০ ডিসেম্বর ছাতক শহরের কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় প্রবাসী কবরস্থানের পাশে তাকে চিরশায়িত করে রাখা হয়। দীর্ঘদিন তার সমাধিস্থলটি অযন্তে-অবহেলায় ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা পড়ে ছিলো। চতুর্দিকে বাসাবাড়ি, ময়লা-আবর্জনার স্তুপ ও দোকানকোটা তৈরী হওয়ায় মানুষের নজরের আড়ালে চলে গিয়েছিলো তার কবরস্থানটি। সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত বাঁশতলায় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এই সহচরের সমাধিস্থলটি আনুষ্ঠানিক স্থানান্তর করা হয় ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে।
এমএনএ আব্দুল হক ১৯৩০ সালে সুনামগঞ্জের ছাতক থানাধীন ভাতগাঁও গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভী আব্দুল ওয়াহিদ ও মাতা সাহেবা খাতুন অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পরিবারে জেষ্ঠ্য সন্তান। তার মেজো ভাই মরহুম আবুল হাসনাত আব্দুল হাই ছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাতক-দোয়ারা নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-৫ আসন থেকে আব্দুল হাই পরপর ৩ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এমএনএ আব্দুল হক ১৯৫১ সালে সুনামগঞ্জ সরকারী জুবিলী হাইস্কুল থেকে মেট্টিক পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হন। তিনি আইএ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিম উলাহ হলে জিএস নির্বাচিত হন। পরে হাইকোর্টে আইন পেশায়ও নিযুক্ত হন তিনি।
১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ওয়েষ্ট এন্ড হাইস্কুলে তিনি কয়েক বছর শিক্ষকতাও করেছেন। সুনামগঞ্জের ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আব্দুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৫৫ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘ ১৩ মাস কারাভোগ করেন। রাজপথের অগ্রসৈনিক আব্দুল হক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে বৃহত্তর ছাতক (ছাতক- দোয়ারাবাজার-কোম্পানীগঞ্জ) ও জগন্নাথপুর থানা নিয়ে গঠিত পাকিস্থান জাতীয় পরিষদ আসনে এমএনএ নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন হিসেবে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৫নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা ও ছাতক-জগন্নাথপুর-দিরাই’র প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল হক।
মরহুম এমএন এ আব্দুল হককে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৭২ সালে ছাতকের গোবিন্দগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করা হয় আব্দুল হক স্মৃতি ডিগ্রী কলেজ। ৭২ পরবর্তি ২৫ বছর ছাতকের এ মহান নেতার নামে উলেখযোগ্য কিছু করতে দেখা যায়নি। দীর্ঘ ২৫ বছর ছাতকের কিংবদন্তি পুরুষ আব্দুল হক এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে রাখা হয়েছে প্রচার বিমুখ।
১৯৯৬ পরবর্তি সময়ে আওয়ামী সরকারের আমলে মুহিবুর রহমান মানিক এমপি মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টর হেড কোয়াটার বাঁশতলায় প্রতিষ্টা করেন এমএনএ আব্দুল হকের নামে হক নগর ও স্মৃতিসৌধ, জাউয়া বাজার ডিগ্রী কলেজে আব্দুল হক স্মৃতি ভবন নির্মাণ করেন।বর্তমানে বাশঁতলা-হকনগর একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে।
এই পর্যটন কেন্দ্রেই তার সমাধিস্থল স্থানান্তর হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকরা তার বীরত্বগাথা ইতিহাস জানতে পারবেন বলে স্থানীয়দের ধারনা।
