লাউড় রাজ্যের রাজধানীর দুর্গ ও প্রাচীর ধ্বংসের পথে

নুর উদ্দিন, ছাতক (সুনামগঞ্জ)প্রতিনিধি :

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানীর দুর্গ ও প্রাচীর সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের উপক্রম হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মতে, প্রাচীনকাল হতে শ্রীহট্ট (সিলেট) কয়েকটি খন্ডে রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ত্রৈপুরা রাজবংশ অধ্যুষিত স্থান ত্রিপুরা রাজ্য বলে সাধারণত কথিত হয়। এই রাজবংশের অধিকার এক সময় বরবক্রের সমস্ত বাম তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শ্রীহট্টের তিন ভাগ তিনজন পৃথক নৃপতি দ্বারা শাসিত হতো। গৌড়, লাউড় ও জয়ন্তিয়া এই তিন খন্ডের নৃপতির অধীনস্ত ছিলেন আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমি মালিক।
জানা যায়, লাউড় রাজ্য ছিল সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ জেলার কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। লাউড় ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য। বর্তমান তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল। এই রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ তাহিরপুরের দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নের হলহলিয়া গ্রামে এখনো বিদ্যমান। এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কেশব মিশ্র। তারা ছিলেন কাত্যান গোত্রীয় মিশ্র। তাদের উপাধি ছিল সিংহ। খ্রিস্টীয় দশম অথবা একাদশ শতকে কেশব মিশ্র কনৌজ থেকে এখানে আসেন। দ্বাদশ শতকে এখানে বিজয় মাণিক্য নামের নৃপতি রাজত্ব করতেন। কারো কারো মতে, বঙ্গ বিজয়ের পর রাঢ় অঞ্চল মুসলমানদের হাতে চলে যাওয়ায় সেখানকার বিতাড়িত ও পরাজিত সম্ভ্রান্তজনেরা প্রাণ ও মান বাঁচানোর জন্য চারদিকে ছড়িয়ে ছিলেন। তাদেরই একজন এখানে এসে রাজত্ব গড়ে তোলেন। রাঢ় শব্দ হতেই লাউড় শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়।
লাউড় রাজ্যের রাজধানী লাউড় ছাড়াও সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর ও হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে আরও দুটি উপ-রাজধানী ছিল। ঐতিহাসিক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, সম্ভবত ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে লাউড় রাজ্য স্বাধীনতা হারায় এবং মোগলরা এর নিয়ন্ত্রক হন।
লেখক সৈয়দ মুর্তজা আলী তার রচিত ‘হযরত শাহ্জালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) লাউড়ের রাজা গোবিন্দ সিংহ তার জ্ঞাতি ভ্রাতা জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহের সঙ্গে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এর জের ধরেই বিজয় সিংহ গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হন। বিজয় সিংহের বংশধররা এ হত্যাকান্ডের জন্য গোবিন্দ সিংহকে দায়ী করেন এবং তার বিরুদ্ধে মোগল সম্রাট আকবরের রাজদরবারে বিচার প্রার্থনা করেন। এ ঘটনার বিচারের জন্য সম্রাট আকবর দিল্লি থেকে সৈন্য পাঠিয়ে গোবিন্দ সিংহকে দিল্লিতে ডেকে নেন। বিচারে গোবিন্দ সিংহের ফাঁসির হুকুম হয়। গোবিন্দ সিংহের অপর নাম ছিল জয় সিংহ। একই সময়ে জয়সিংহ নামের অপর এক ব্যক্তি রাজা গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে সম্রাট আকবরের কারাগারে আটক ছিলেন। ভুলবশত প্রহরীরা গোবিন্দ সিংহের পরিবর্তে জয়সিংহকে ফাঁসিতে ঝুলান।
গোবিন্দ সিংহের প্রাণ এভাবে রক্ষা পাওয়ায় তিনি কৌশলে সম্রাট আকবরের কাছ থেকে নানা সুযোগ গ্রহণ করেন। তিনি সম্রাট আকবরের কাছে প্রাণভিক্ষা চান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। গোবিন্দ সিংহের নাম হয় হাবিব খাঁ। সম্রাট আকবর গোবিন্দ সিংহকে তার হৃতরাজ্য পুনরায় দান করেন। অবশ্য শর্ত দেওয়া হয় হাবিব খাঁ সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করবেন এবং সম্রাটের খাজনার পরিবর্তে ৬৮ খানা কোষা নৌকা নির্মাণ করে সম্রাটকে সরবরাহ করবেন। এই নৌকাগুলো খাসিয়াদের আগ্রাসন হতে আত্মরক্ষার জন্য মোগল ও স্থানীয় বাহিনী কর্তৃক রণতরী হিসাবে ব্যবহার করা হবে।
প্রাচীণ নানা গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, হাবিব খাঁর পৌত্র ছিলেন মজলিস আলম খাঁ। মজলিস আলম খাঁর পুত্র ছিলেন আনোয়ার খাঁ। তিনি খাসিয়াদের উৎপাতের কারণে সপরিবারে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের লাউড় ছেড়ে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে চলে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। এই বংশেরই উমেদ রাজা লাউড়ে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গের ধ্বংসাবশেষই লাউড়ের হাউলি বা হাবেলি নামে পরিচিত। বর্তমানে এই দুর্গের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। প্রতিটি প্রকোষ্ঠের কারুকার্য দেখলে যে কেউ মনে করবেন এখানে সম্ভ্রান্ত কোনো রাজা বা নৃপতি বসবাস করতেন।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল হলহলিয়া, এখানকার ধ্বংসাবশেষও তাই জানান দিচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দ্রুত সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে ক্রমেই সংরক্ষণের বিষয়টি জটিল হয়ে যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুনামগঞ্জে সাত গ্রামের জমি রেজিস্ট্রি বন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ২৭ বছর পর ৪২০ শিক্ষকের পদোন্নতি