নুর উদ্দিন, ছাতক (সুনামগঞ্জ)প্রতিনিধি,পপুলার২৪নিউজ:
সুনামগঞ্জে দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুগুয়া হাওরের জীব বৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। মাদার ফিসারিজ অব টাঙ্গুগুয়া হাওর থেকে প্রতিনিয়ত জ্বালানী হিসাবে নলখাগড়া, চাইল্যাবন, হিজল, করচ গাছ, অবাধে কেটে নিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণীর বনখেকোরা। ফলে হাওর থেকে উজাড় করা হচ্ছে ঘন সবুজের সমারোহ।
বিশাল টাঙ্গুগুয়া হাওরের জলারাশির চারদিকে হিজল–করচ, নলখাগড়া, চাইল্যাবনসহ বিভিন্ন জাতীয় গাছ গাছালীতে কিছুদিন আগে অতিথি পাখিদের অভয়াশ্রম ছিল। প্রাকৃতিক ভরপুর টাঙ্গুগুয়া হাওরের জীব বৈচিত্র্য নিজস্ব সৌন্দর্য্য হারানোর পাশাপাশি ক্রমশ হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে বিপন্ন হচ্ছে হাওর ও হাওরের চারদিকের পরিবেশ।
জানা যায়, ৯০ দশকের শুরুতে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার বিষয়টি মিডিয়ায় উঠে আসলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশের আটটি স্থানকে স্পর্শকাতর উল্লেখ করে পরিবেশ সংরক্ষণের দাবী উঠায়। তখন বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের সঙ্গে টাঙ্গুগুয়ার হাওর, যশোহরের মাঠচান্দ, কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া দ্বীপ, টেকনাফের উপকুলীয় অঞ্চল, সিলেটের কুলাউড়ার মাধবকুন্ড জলর্প্রপাত ও হাকালুকি হাওরকে পরিবেশের জন্য স্পর্শকাতর এলাকা হিসাবে ঘোষিত হয়। এই আটটি স্থানকে ১৯৯৭ সালে ২৮ আগষ্ট জারিকৃত পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা কার্যকর করা হয়। সারা বিশ্বে রামসারভূক্ত স্পট হচ্ছে ১০৩১ টি। এর মধ্যে টাঙ্গুগুয়ার হাওর একটি অন্যতম স্পট। রামসার কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পরিচিতি ঘটে ১৯৯২ সালের মে মাসে। পরবর্তীকালে রামসার সাইট হিসাবে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় সুন্দরবন ও টাঙ্গুগুয়া হাওর। রামসা ঘোষণার পর টাঙ্গুগুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি কমার্শিয়াল এমনকি পর্যটন শিল্পের দিক নিয়েও নতুন সম্ভাবনা জেগে উঠে। হাওর এলাকার জনগণের অংশীদারীত্বে হাওর ব্যবস্থানার মাধ্যমে ইকোসিষ্টেম ট্যুরিজম গড়ে তোলার জন্য নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। হাওর এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ সালে ১২ফেব্রুয়ারী একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৩ সালে ৮ নভেম্বর জেলা প্রশাসন পুলিশ বিডিআর আনসারদের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে টাঙ্গুগুয়া হাওর থেকে ইজারাদার গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে হাওরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা হয় সরকারি ব্যবস্থাপনায়। ইজারাপ্রতা বাতিল হওয়ার পর জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে টাঙ্গুগুয়ার হাওর রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে সপ্তাহে একজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতত্বে ৪টি দলে নিয়োজিত করা হয় পুলিশ আনসার। ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায় বেসরকারী এনজিও সংস্থা আইইউসিএন। প্রায় ১০ হাজার হেক্টর আয়তনের অধিক জলসীমা বেষ্টিত ৫২টি ছোট বড় বিলের সমন্বয়ে গঠিত টাঙ্গুগুয়া হাওরে ২০০৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় আইইউসিএনের সহায়তায় টাঙ্গুগুয়া হাওরের সার্বিক উন্নয়নে প্রথম ধাপে ৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের ভিত্তিতে ১০ বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। গৃহীত প্রকল্পের আওতায় টাঙ্গুগুয়ার হাওর তীরবর্তী ৮৮টি গ্রামের অধিবাসীদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, হাওর ইকোট্যুরিজম, ৫১টি বিল এলাকার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ আহরণ রোধ, এলাকাবাসীদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জনগণকে সংগঠিত করার ব্যবস্থা রেখে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়। টাঙ্গুগুয়া হাওরে গত ১৩ বছর আগেও হাজার হাজার হিজল করচ গাছ, নলখাগড়া, ঝাউবন চাইল্যাবন, বরুণ, পানিফল ,হেলেঞ্চা, বনতুসী, বল্লূয়াসহ নানা প্রজাতির গাছ ও বন ছিল। হাওরের সুবিশাল জল রাশির বুকে ও চার পাশ জুড়ে ছিল ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রজাতির গিরিগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ১৫০ প্রজাতির জলজ ও জলপদ্ম জাতীয় উদ্ভিদ এছাড়াও দুর্লভ প্রজাতির প্যালাসেস ফিশিং ঈগল। আইইউসিএন দায়িত্ব নেয়ার পর বদলে গেছে টাঙ্গুগুয়া হাওরের দৃশ্যপট। অবৈধ ভাবে হিজল, করচ গাছ, কাটা অব্যাহত থাকায় পাখি শূন্য হচ্ছে হাওরটি।
সরেজমিনে টাঙ্গুগুয়ার হাওর ঘুরে দেখা যায়,হাওরপারের জনগণ জ্বালানী চাহিদা মেটাতে নলখাগড়া, বনতুলসী, চাইল্যাবন, হিজল-করচ গাছের ডালপালা ছোট ছোট নৌকা বোঝাই করে কেটে নিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।
বিনোদপুর গ্রামের অশ্বিনি বর্মন, পানিয়াখালী গ্রামের রহিম উদ্দিন জানায়, বর্ষাকালে জ্বালানী চাহিদা পূরণের জন্য তারা বনতুলসী ও নলখাগড়া কেটে নিয়ে যায়। দায়িত্বে থাকা আনসার পুলিশ আটকালে কি করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ২০/৫০ টাকা হাতে তুলে দিলেই তারা চুপ থাকে। হাওর পাড়ের হাবলু জানান, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ আনসাররা নিজেদের পকেট ভারী করতে যেমন মাছ ধরা ও গাছ কাটার সুযোগ দিচ্ছেন, তেমনি তদারকির অভাব ও আইইউসিএনের তত্বাবধানে টাঙ্গুগুয়া হাওরের সার্বিক উন্নয়ন কাজে থাকা সিএনআরএস সহ অন্যান্য এনজিওগুলো হাওরে শুধু ফাইল ওয়ার্ক করেছেন। ইজারা প্রথা বাতিলের পর ২০০৩ সালে টাঙ্গুগুয়া হাওরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পায় জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন থেকে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে টাঙ্গুগুয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় আইইউসিএন কে। ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত আইইউসিএন টাঙ্গুগুয়া হাওরের দায়িত্ব পালন করে। এরপর আবার সময় বাড়িয়ে ১৬ মাসের জন্য অর্থাৎ ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত টাঙ্গুগুয়া হাওরের দেখভালের দায়িত্বে পায় আইইউসিএন। অভিযোগ রয়েছে, আইইউসিএন টাঙ্গুগুয়া হাওরের উন্নয়ন-জীব বৈচিত্র রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। আইইউসিএনের কো-অর্ডিনেটর ওয়াহিদুজ্জামান সরকার বলেন, হাওরের গাছগাছালি ও বন কেটে নেয়ার বিষয়টি আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনকে অবহিত করেছি। বনখেকোদের সাথে আনসারদের অবৈধ যোগসাজসের কারণে টাঙ্গুগুয়া হাওর উজার হয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গুগুয়া হাওরে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে সিএনআরএস প্রকল্প সমন্বয়কারী ইয়াহিয়া সাজ্জাত বলেন, টাঙ্গুগুয়া হাওরের গাছগাছালির ডালপালা না কাটার জন্য আমরা স্থানীয় জনগণকে নিষেধাজ্ঞা করেছি এবং জনগণকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন সময়ে কর্মশালা করেছি।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, হাওরপারের লোকজনদের জনসচেতনতামূলক কর্মশালার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে তারা নিজ দায়িত্ব থেকেই টাঙ্গুগুয়া হাওর সুরক্ষা করতে পারে। গত পয়েলা জুলাই সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউজে টাঙ্গুগুয়া হাওর সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়ের প্রশাসন বিভাগের মহাপরিচালক কবির বিন আনোয়ার বলেন, দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুগুয়া হাওরে প্রায় ৯ বছর দেখভাল করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন)। সুনির্দিষ্টভাবে বললে- এই সময়ে হাওরের মাছ ও জীব বৈচিত্র রক্ষায় আইইউসিএন সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
