প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে বহু মানুষ৷ এমনই এক দুর্ঘটনায় ১৯৮৯ সালে মারা যান দৈনিক সংবাদের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু৷ ১৯৯১ সালে তার স্ত্রী রওশন আখতার ক্ষতিপূরণ মামলা করেন, যা আজও তিনি পাননি৷
দীর্ঘ ২৬ বছর মামলা চলার পর ২০১৬ সালে রওশন আখতারকে ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত৷ কিন্তু কোথায় কী? জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের কাছে দীর্ঘ এই আইনি লড়াইয়ের বিবরণ তুলে ধরেছেন রওশন আখতার৷
প্রশ্ন : আপনার স্বামী ১৯৮৯ সালে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান৷ এর পর তো আপনি একটা লম্বা আইনি যুদ্ধ চালাচ্ছেন৷ তার সর্বশেষ অবস্থা যদি একটু বলেন…।
রওশন আখতার : সংক্ষেপে যদি প্রেক্ষাপটটা বলি, তাহলে ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে মামলাটা করা হল৷ এর পর ১৪ বছর ধরে মামলা চলল৷ তার পর রায়ে আমাকে তিন কোটি ৫৩ লাখ টাকা দিতে বলা হল৷ আমি যেটি দাবি করেছিলাম সেটিই৷ অন্যদিকে শেখ ফজলে নূর তাপস হলেন আইনজীবী আর তার আপন ভায়রা হলেন বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক৷ ওনারা আপিল করলেন৷ সেখানে আবার পাঁচ বছর লাগল হাইকোর্টে রায় হতে৷
২০১০ সালে হাইকোর্টে রায় হল। জজকোর্টের রায় হয়েছিল ২০০৫ সালে৷ হাইকোর্টে টাকাটা কমিয়ে দেয়া হল৷ তখন ২ কোটি ১ লাখ টাকা সাত দিনের মধ্যে দিতে বলা হল৷ জজকোর্টে ৩০ দিনের মধ্যে দিতে বলা হয়েছিল৷
এর পর তারা লিভ টু আপিল করল৷ সেখানে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে রায় হল৷ সেখানে আপিল খারিজ হয়ে গেল৷ তখন প্রধান বিচারপতি এবং অন্য দুজন বিচারপতি আমাকে বললেন যে, তারা টাকাটা রি-অ্যাসেসমেন্ট করবেন৷ কারণ ১৯৯১ সালের মামলা ২০১৬ সালে হচ্ছে৷ তাই রি-অ্যাসেসমেন্টের ব্যাপার আছে৷ সুদে-আসলে বাড়বে এটিই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন ওনারা৷
কথা ছিল, রি-অ্যাসেসমেন্ট করে ওনারা জাজমেন্টের কপি দেবেন৷ কিন্তু ছ’মাস হয়ে গেল জাজমেন্টের কপি আর দেয়া হয়নি৷ এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি অবসরে চলে গেলেন৷ আবার চার দিনের নোটিশে রিকল করল৷ তখন এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতি৷ রিকল করে কী করা হল… তখন আবার ৩২ লাখ টাকা কমিয়ে দেয়া হল৷ অর্থাৎ আমাকে ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা দিতে বলা হল৷ তখন মৌখিকভাবে বলা হল, সাত দিনের মধ্যে টাকাটা দিয়ে দিতে৷ কিন্তু লিখিত দেয়নি৷
ওই সময়ের মধ্যে টাকা দেয়া তো দূরের কথা, উল্টে আমাকে টাকা পাওয়ার জন্য লোয়ার কোর্টে মামলা ফাইল করতে হল৷ সেই টাকাও দিচ্ছেই না৷ বরং প্রতিদিন কোর্ট থেকে রেকর্ডটা দেখে যায়, ফলোআপ করে যায়৷ যেহেতু টাকা দেয়নি, তাই তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার তিনটা প্লট মিলে পাঁচ বিঘা জমি ক্রোক করা হল৷ এর পর আমাকে দুবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হল৷ এতে এক লাখ টাকা খরচ হল৷ এ ছাড়া আরও অনেক টাকা খরচ হয়েছে৷
সেখানে নিলামের যে ফর্মালিটিজ করা হয়, কিন্তু কেউ উপস্থিত হয় না৷ আসলে উপস্থিত হতে দেয় না৷ এভাবে গত মাস পর্যন্ত দুবার নিলাম হয়ে গেছে৷ কেউ আসে না, ডাক ওঠে না৷ ফলে জমিটাও বিক্রি করা যায়নি৷ আর আমার টাকাও পাইনি৷
প্রশ্ন : আপনি তো দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন৷ তা এই লড়াই করতে গিয়ে আপনার কী কী প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে?
রওশন আখতার : প্রতিকূলতা বলতে কী? আক্ষরিক অর্থে না বললেও আমার লড়াইটা ছিল জাহাজের সঙ্গে ডিঙ্গি নৌকার৷ আমার প্রতিপক্ষ চরম ক্ষমতাশালী আর আমি ততই দুর্বল একজন কলেজ শিক্ষক৷ আমার পক্ষে এই লড়াইয়ে যাওয়া মানে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া৷ কারণ ওদের প্রচুর টাকা আর আমার নেই খাওয়ার পয়সা৷
প্রশ্ন : এই লড়াইটা করতে গিয়ে আপনাকে তো প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়েছে?
রওশন আখতার : প্রচুর টাকা৷ ১৯৮৯ সালে আমার বেতন যেখানে সর্বসাকল্যে দেড় হাজার টাকা, তখন প্রতি মাসে ৬০০ টাকা রাখতে হতো ক্ল্যারিকাল ফি হিসেবে কোর্টের জন্য৷ বাকি টাকা দিয়ে কীভাবে চলেছি, তা আমিই জানি৷ বাবার বাড়িতে থাকি, তাই ভাড়া লাগে না৷ তখন আমার ছোট দুটি বাচ্চা ছিল৷ নয় বছর আর পাঁচ বছর৷ সৈয়দ হাসান ইমাম স্কুলে তাদের ফ্রি পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিল৷ তার পর সৈয়দ হাসান ইমাম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে মাসে এক হাজার টাকার একটা ভাতা করে দিয়েছিলেন৷ এগুলো দিয়ে চলছিল৷ এ ছাড়া আমার বাবা সাহায্য করেছিলেন৷ আমার ভাই আমেরিকায় থাকেন, তিনি কিছু সাহায্য করেছিলেন৷ তবে আমার শরীরের ওপর দিয়ে পরিশ্রম গেছে৷
প্রশ্ন: আপনার তো দুটি ছেলে৷ এদের মধ্যে কয়েক দিন আগে একজনের বিয়ে হয়েছে৷ তাই না?
রওশন আখতার : হ্যাঁ, কয়েক দিন আগে ছোট ছেলের বিয়ে হয়েছে৷ এই জার্নিতে আমাকে শারীরিকভাবে, আর্থিকভাবে, মানসিকভাবে এবং সামাজিকভাবে– এই চারভাবে পর্যদুস্ত হতে হয়েছে৷
প্রশ্ন : এখনও আপনি তা হলে কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি?
রওশন আখতার : পাইনি তো বটেই, উল্টে আমাকে নিম্নআদালতে দুই বছর ধরে মামলা চালাতে হচ্ছে৷ এতে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে৷ আপনি বলবেন টাকা কোথায় পাচ্ছেন? ছয় লাখ টাকা এককালীন পাওয়ার জন্য আমার পেনশন অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিয়েছি৷ অনেক ধার হয়ে গিয়েছিল৷ সেগুলো শোধ করার জন্য এটা করতে হয়েছে৷ পেনশনের টাকা দিয়ে, গ্রাচুইটির টাকা দিয়ে ধার শোধ করেছি৷ এখন ১০ বছর হলো আমি কোনো পেনশন পাই না৷
তাহলে বলবেন, মামলা চালাই কীভাবে? আমার যে ছেলেটা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ওর বেতনের টাকা দিয়ে এখন মামলা চালাচ্ছি৷ হয়তো বলবেন, ছেলেকে বিয়ে দিলেন কীভাবে? আমার ছোট ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোন নিয়ে বিয়ে করেছে৷ আর বড় ছেলে এমন চাকরি করে, যেখানে লোন করার সুযোগ নেই৷ ফলে তার বিয়েও দিতে পারছি না৷
প্রশ্ন : আপনার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর আপনি কি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কোনো কাজ করেছেন?
রওশন আখতার : না৷ আমি তো জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক ছিলাম৷ কবি নজরুল কলেজের শিক্ষক ছিলাম৷ আমার পারিবারিক ঝামেলা অনেক বেশি ছিল৷ আমার নিজের দুটো বাচ্চা৷ তার ওপর আমার বাবা ২৫ বছর মানসিক রোগী ছিলেন, তাকে দেখতে হতো৷ এগুলো করার পর আমি যে আলাদা কোনো কাজ করব, তার কোনো উপায় ছিল না৷ এমনকি দুটি পয়সা অন্য কাজ করেও উপার্জন করার সুযোগও ছিল না৷
প্রশ্ন : সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমাদের দেশে যে আইন আছে, সেটি কি পর্যাপ্ত?
রওশন আখতার : ক্ষতিপূরণ মামলাটাকে বলে ‘টট কেস’৷ এই আইনটা তো প্রথম আমাদের দেশে কার্যকর হল আমার মামলা দিয়েই৷ বাংলাদেশে এ ধরনের মামলার এটিই প্রথম নজির৷ বিদেশে এ আইনে প্রচুর মামলা হয়৷ আমাদের দেশে দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনে কিছু ত্রুটি থাকার কারণে এ মামলাগুলো কেউ করে না৷
প্রশ্ন : ১৯৯১ সালে আপনি এ মামলা করেছিলেন৷ তখন এ মামলার কথা কেন মনে হল?
রওশন আখতার : আমার স্বামীর অবদান এবং পাণ্ডিত্য বিবেচনা করে সংবাদ কর্তৃপক্ষ তখন আমাকে ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে দেয়নি৷ তারা বলল, আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হবার নয়৷ কিন্তু আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা চালাব৷ আসলে আমার তখন কোনো ধারণাই ছিল না৷
তখন এ মামলার আইনজীবী ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক৷ মারা গেছেন উনি৷ আমি একদিন ওনার বাসায় গেলাম৷ তখন ওনার জুনিয়র আমাকে বললেন, ‘সংবাদ থেকে তো কোনো টাকা দেয় না, এ মামলা আমরা কীভাবে চালাব?’
তখন আমি বললাম, ‘তা হলে আমি মামলা তুলে নিই৷ কারণ আমার পক্ষে এ মামলা চালানো সম্ভব নয়৷ যেহেতু সংবাদ টাকা দেয় না, সেহেতু এ মামলা চালিয়ে কোনো লাভ নেই৷’
আমিনুল হক আমাকে বললেন, ‘প্লিজ আপনি মামলাটা তুলে নেবেন না৷ আমি এটি চালাব৷ আমাদের দেশে এ ক্ষতিপূরণ মামলার কোনো নজির নেই৷ আমি একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই৷ আমার ভাই সার্জেন্ট জহুরুল হককে যখন আগরতলা মামলায় মেরে ফেলল, তখন এক টাকা দাবি করে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছিলাম৷ নজির সৃষ্টি করার জন্য৷ কিন্তু এর পর মুক্তিযুদ্ধ হল৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানও নেই৷ ফলে সেই মামলাও নেই৷ এখন আপনার মামলা পেলাম, এটি দিয়ে একটা নজির সৃষ্টি করতে চাই৷’
এর পর উনি মারা গেলেন৷ ফলে মামলাটাও হারিয়ে গেল৷ কারণ ওই মামলার কোনো বাপ-মা ছিল না৷ এর পর বর্তমান যিনি আইনজীবী খলিলুর রহমান, তার সঙ্গে আমাদের একটা পারিবারিক যোগাযোগ ছিল৷ ওনার কাছে যখন গেলাম, তখন মামলার কোনো কাগজপত্র আমাদের কাছে নেই৷ শুধু অভিযোগ আর উত্তর নিয়েই উনি অ্যামেন্ডমেন্ট করে মামলা আবার চালু করলেন৷ তখন থেকে উনিই মামলা চালাচ্ছেন৷
প্রশ্ন : আপনি যাদের সঙ্গে লড়াই করছেন, তারা তো অনেক ক্ষমতাধর৷ তারা কি কখনও আপনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে? অথবা লাঞ্ছনাকর কোনো পরিস্থিতিতে কখনও পড়েছেন?
রওশন আখতার : না৷ তারা এই কাজ কখনও করেনি৷ তারা এতটাই প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাশালী যে তাদের কাছে আমি অতি তুচ্ছ এক জীব৷ আমাকে কাউন্ট করার মতো কোনো প্রয়োজনীয়তা তাদের নেই৷
প্রশ্ন : সমঝোতার জন্য তারা কি তখন আপনাকে প্রস্তাব দিয়েছিল?
রওশন আখতার : আমাকে তারা কোনো প্রস্তাব দেননি৷ আমার স্বামী যখন মারা গেল, তখন বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক ছিলেন আমানুল্লাহ সাহেব৷ উনি সমবেদনা জানাতে ওনার ভাইকে এবং মামলার আইও-কে একবার আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন কম্প্রোমাইজ করার জন্য৷ আমি তো তখন আসলে মামলাও বুঝি না, কম্প্রোমাইজও বুঝি না৷ আমি ছিলাম তখন ইমব্যালেন্সড৷ ফলে প্রশ্ন আসেনি যে কত টাকা দেবে বা কী পাব৷
প্রশ্ন : নিম্নআদালতে আপনি জেতার পর কি তারা কখনও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে?
রওশন আখতার : না, তারা কোনো যোগাযোগ করেনি৷ বরং নিম্নআদালতে ঘুরতে ঘুরতে আমি একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ওনাদের আইনজীবীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, ভাই আমাকে দু-চার লাখ টাকা দিয়ে দিন৷ আমি আর এই মামলা চালাব না৷ আপনি ওনাদের সঙ্গে আলাপ করুন৷ তখন তার কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাইনি৷ প্রশ্ন : আপনার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন৷ প্রতিদিনই বহু মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন৷ এই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যদি দেশবাসীর উদ্দেশে আপনি কিছু বলতে চান…?
রওশন আখতার : এ মামলা করে আমি ভিকটিম হলাম৷ কারণ এ মামলা করে টাকা পাওয়ার কোনো উপায় এখনও আমি দেখছি না৷ তাই অপরপক্ষ যদি শক্তিশালী হয়, তা হলে আমি সবাইকে পরামর্শ দেব যে, তারা যেন ক্ষতিপূরণ মামলা না করেন৷ আপসে যদি তারা কিছু দেয়, সেটা হাত পেতে নেয়া উচিত৷ মামলা করে টাকা পাওয়ার জন্য যে পদ্ধতি বা আইন, সেটি আমাদের দেশে সেভাবে নেই৷
