নিজস্ব প্রতিবেদক: দফায় দফায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা ও ময়দা কিনতে সংকটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে আটা-ময়দার বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। খোলা ও প্যাকেটজাত উভয় ধরনের আটার দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে চালের কেজিও ১ টাকা থেকে ২ টাকা বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের সংসার খরচে আরেক দফা চাপ বেড়েছে। সবজি বাদে বাজারে কোনো পণ্যেই স্বস্তি মিলছে না। মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য নিয়ে। এ অবস্থায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষের।
শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে প্রধান প্রধান প্রায় সবধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে আবার বাড়তি দামেও মিলছে না কোনো কোনো পণ্য। সেগুলো কোথাও আছে, কোথাও নেই। এ তালিকায় রয়েছে চিনি, সয়াবিন তেল, আটা ও ময়দা। পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানগুলোতেও দেখা গেছে একই চিত্র।
দেখা যায়, ক্রেতারা কোনো একটি দোকানে আটা-ময়দা পেলেও হয়তো চিনি পাচ্ছেন না। আবার কোথাও গিয়ে চিনি মিললেও সেখানে নেই সয়াবিন তেল কিংবা আটা। আবার কোথাও এসব পণ্যের মোড়কজাত দু-একটি প্যাকেট থাকলেও নেই খোলা পণ্য। এ কারণে কাঙ্খিত পণ্য পেতে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ছুটতে হচ্ছে ক্রেতাদের। কেউ আবার বাধ্য হয়ে বেশি দামে পণ্য কিনছেন।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বরিশালের কামাল হোসেন। মাসিক বেতন ৩৫ হাজার টাকা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে মিরপুরে বাসাভাড়া করে থাকেন।
জানতে চাইলে কামাল বলেন, মাস শেষে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলসহ বাসাভাড়া দিতে হয় ১৫ হাজার টাকা। এখন সবকিছুর দাম বাড়ছে। সঞ্চয় তো দূরে, কীভাবে সংসার চালাব, সেটি নিয়ে ভেবে কোনো কূল পাচ্ছি না। করোনার ধাক্কায় অনেক মানুষের আয় কমেছে। চাকরি হারানোর তালিকাও বেশ লম্বা। কামাল আরও বলেন, বাজারে একের পর এক জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। পরিস্থিতি যেন আমাদের মতো মানুষের বেঁচে থাকার অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। সংসারের খরচ কমাতে কমাতে এমন জায়গায় গেছে, আর উপায় নেই। এখন একবেলা না খেয়ে থাকতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজারে দেখা দিয়েছে সয়াবিন তেলের সংকট চিনি সংকট। এদিকে গত ১ নভেম্বর সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। তারপরই বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
কলতাবাজারের অনেক দোকান রয়েছে। এরমধ্যে দু-একটি দোকান বাদে অধিকাংশ দোকানেই কোনো না কোনো পণ্য নেই। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি সংকট চিনি ও সয়াবিন তেলের। ভোজ্যতেল পাওয়া গেলেও সেখানে বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে। নেই খোলা কোনো সয়াবিন বা পাম তেল।
সেখানের মুদি দোকানিরা বলেন, কয়েকদিন থেকে কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা আসছেন না। মাঝেমধ্যে এলেও কাঙ্খিত পণ্য দিতে পারছেন না। বিশেষ করে তেল দেওয়া প্রায় বন্ধ রেখেছে কোম্পানিগুলো। যাদের কাছে আগের কেনা তেল রয়েছে, তারা কিছু কিছু করে বিক্রি করছেন এখন।
তিনি বলেন, রেগুলার কাস্টমারদের কাছে তেল বিক্রি করছি। পাইকারি অথবা একজন ক্রেতার কাছে বেশি পণ্য বিক্রি বন্ধ এখন।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, একেক দোকানে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। কোথাও রূপচাঁদার ২ লিটারের তেলের বোতল ৩৭০ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে, আবার কোথাও একই তেল ৩৮৪ টাকা। একই পরিমাণ তেল বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের দাম ৪১০ টাকাও বিক্রি হতে দেখা গেছে। তীর ব্র্যান্ডের এক লিটার বোতলজাত তেল ১৭৮ টাকা আবার কোথাও একই তেল ১৯২ টাকাও লেখা বোতলের গায়ে।
রায়সাহেব বাজারে আসা স্কুলশিক্ষক অনুপ হাওলাদার বলেন, তেল, চিনি ও আটা-ময়দা যেসব পণ্যের সংকট রয়েছে, সেগুলোর বাজার কয়েকটি কোম্পানির দখলে। তারা বিশ্ববাজার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে অজুহাত করে বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ানো হয়েছে বিশ্ববাজারে তা ততটা বাড়েনি।
তিনি বলেন, এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলেই তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। এ পরিস্থিতিতে ভোক্তারা একদম নাজেহাল।
এদিকে খুচরা বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। তিনদিন আগেও এ চিনির দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা কম ছিল। আর প্রতি কেজি খোলা আটা ৬৫ টাকার নিচে মিলছে না। যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্য মতে, গত এক বছরের ব্যবধানে বাজারে আটার দাম ৭৯ দশমিক ১০ শতাংশ বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ।
শুধু আটা নয়, একইভাবে ময়দার দামও বেড়েছে বাজারে। খোলা ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। টিসিবি বলছে, বছরের ব্যবধানে ময়দার দাম ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১৬ শতাংশ।
দোকানিরা বলছেন, প্যাকেটজাত আটার সরবরাহ কিছুটা কম। এক সপ্তাহ আগে খুচরা ব্যবসায়ীরা ডিলারদের কাছ থেকে যেসব আটা ও ময়দা সংগ্রহ করেছেন, সেগুলোই বিক্রি করছেন দোকানিরা। অন্যদিকে পাইকারি বাজারে খোলা আটা-ময়দার চড়া দামের কারণে অনেকে রাখছেন না।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে মোটা ডালের কেজি ১২০ টাকা, চিকন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। এছাড়া ডিমের ডজন ১৪০-১৪৫ টাকা। এ দুই পণ্য আটকে আছে বাড়তি দামে। মুরগির দাম কিছুটা কমেছে।
অন্যদিকে বাজারে চিনির দাম এখনো কমেনি। প্রতি কেজি খোলা চিনি ৯০ টাকা এবং প্যাকেটজাত ৯৫ টাকা নির্ধারিত থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। আবার সরকারি চিনিকলের চিনিগুলো প্রতিকেজি ৮৫ টাকা দর নির্ধারিত থাকলেও সেসব বাজারে মিলছে না।
এদিকে চালের দাম প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। সে কারণে খুচরা বাজারে খোলা চালের দামও বেড়েছে ১-২ টাকা। প্রতি কেজি পায়জাম ও গুটি স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকায়। বিআর-২৮ জাতের চাল ৬০ থেকে ৬২ টাকায়। মিনিকেট চাল কেজি ৭০ টাকা। পাইজাম ৭৫ টাকা থেকে ৮২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে সপ্তাহের পেঁয়াজের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। পেঁয়াজের কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শীতের সবজি ভরপুর থাকায় সপ্তাহ ব্যবধানে অধিকাংশ সবজির দাম কিছুটা কমেছে। সবজির বাজারে বরবটি প্রতি কেজি ৮০ টাকা, পটল ৫০ টাকা, কাকরোল ৬০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৫০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ টাকা, গোল বেগুন ৬০ টাকা আর চিকন বেগুন ৫০ টাকায় বিক্রি করছেন দোকানিরা। সবজির মতো মাছের দামও কিছুটা কমেছে বলে বিক্রেতারা জানিয়েছেন। প্রতি কেজি তেলাপিয়া ১৮০ টাকা, রুই ২৫০ টাকা ৩৫০টাকা, পাঙাশ ১৬০ টাকা, সিলভার কার্প ১৪০ টাকা, শিং মাছ আকার ভেদে ৩০০-৪০০ টাকা এবং চিংড়ি মাছ ৬০০-১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ইলিশ মাছ কেজি বড় আকাড়ে ১৬০০ টাকা মাঝারি ১২০০ টাকা ছোট ৪০০-৬০০ টাকা।