নিউজ ডেস্ক:
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সুসংগঠিত নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী লড়াই-সংঘাত বেড়েই চলেছে। নতুন তথ্যে উঠে এসেছে এমন চিত্র।
সশস্ত্র ওই সব গোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যই বয়সে তরুণ। জীবন বাজি রেখে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা লড়াই করছে।
ঠিক এক বছর আগে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। তারপর থেকেই সেনাঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে টানা বিক্ষোভ চলছে।
সহিংসতার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি যেভাবে বাড়ছে এবং বিরোধীরা যেভাবে সমন্বিত হামলা করছে তাতে এই সংঘাত ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বিবিসি জানায়, সংঘাতের উপর নজরদারি এবং তথ্য সংগ্রহাক প্রতিষ্ঠান অ্যাকলেড (আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট) এর তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমার জুড়েই এখন সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় নানা মাধ্যম থেকে পাওয়া খবরও বলছে, লড়াই করা দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় বেড়েছে এবং তারা একজোট হয়ে লড়ছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র লড়াই এখন শহর এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে, আগে এমনটা দেখা যেত না।
সংঘাতে কত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে সেই তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করা কঠিন। অ্যাকলেড স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এবং অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করেছে সে অনুযায়ী, গত বছর সেনাঅভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে রাজনৈতিক সংঘাতে প্রায় ১২ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গত অগাস্ট থেকে সংঘাত বেশি রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠেছে।
সেনাঅভ্যুত্থানের পর বেশিরভাগ বেসামরিক মানুষ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান। এখন বেশি মানুষ মুখোমুখি লড়াইয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। বেসামরিক নাগরিকরাও এখন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার প্রধান মিশেল ব্যাশেলে বিবিসি-র সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, মিয়ানমারের সংঘাতকে এখন গৃহযুদ্ধই বলা উচিত। তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাপ প্রয়োগের জন্য আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন।
মিয়ানমারের পরিস্থিতি ‘বিপর্যয়কর’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের সংকটকে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ‘জরুরি পরিস্থিতি বলে বিবেচনা করেনি’। এই সংঘাত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া বাহিনীগুলো পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এটি মূলত তরুণদের নিয়ে গঠিত বেসামরিক মিলিশিয়াদের একটি নেটওয়ার্ক।
১৮ বছরের হেরা (ছদ্ম নাম) তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরিকল্পনা স্থগিত করে এখন মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে একটি পিডিএফ প্লাটুনের কমান্ডার হতে চাইছেন। গত বছর সেনাঅভ্যুত্থানের পর তিনি যখন প্রথম জান্তাবিরোধী মিছিলে যোগ দেন তখন তিনি মাত্র হাইস্কুল পাস করেছিলেন।
তিনি বিবিসি-কে বলেন, গত বছর ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভে মিয়া থউই থউই খাইং নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনা তাকে আলোড়িত করে এবং তিনি পিডিএফে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
হেরা পিডিএফ -এ যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করলে তারা বাবা-মা তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারলেন, মেয়ে বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, তখন তারা তা মেনে নেন।
হেরা বলেন, ‘‘তারা আমাকে বলেছেন, ‘যদি তুমি সত্যি এটা করতে চাও, তবে শেষ পর্যন্ত করে যাও। মাঝ পথে ছেড়ে আসবে না’। তারপর আমি আমার প্রশিক্ষকের সঙ্গে কথা বলি এবং প্রশিক্ষণ শেষে বিপ্লবে সম্পূর্ণভাবে যোগ দেই।”
সামরিক অভ্যুত্থানের আগে হেরার মতো মানুষেরা মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখেই বড় হচ্ছিলেন। সামরিক বাহিনী পুনরায় ক্ষমতা দখল করায় তারা খুবই অসন্তুষ্ট হন|
তখন তারা বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী পরিচালিত মিলিশিয়া বাহিনীকে সমর্থন এবং সীমান্ত এলাকায় তাদের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। ওইসব বাহিনী দশকের পর দশক ধরে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ: যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে
অ্যাকলেড একটি অলাভজনক সংস্থা যেটি বিশ্বের নানা প্রান্তে হওয়া রাজনৈতিক সংঘাত ও বিক্ষোভের তথ্য সংগ্রহ করে। এজন্য তারা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের খবর, সুশীল সমাজ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রকাশ করা নানা তথ্য এবং স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার নিরাপত্তা আপডেট থেকে তথ্য পেয়ে থাকে।
যদিও অ্যাকলেড বা এসিএলইডি ব্যক্তিগতভাব ওই তথ্য যাচাই করে না। তারা বলে, নতুন করে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতেই প্রতিনিয়ত নিজেদের তথ্যভাণ্ডার আপডেট করা হয়।
যদিও সংঘাতময় এলাকা থেকে সব তথ্য পাওয়া কঠিন। কারণ, সেখান থেকে পাওয়া তথ্য অনেক সময় পক্ষপাতমূলক এবং অসম্পূর্ণ থাকে। অ্যাকলেডের নীতি হচ্ছে, তারা সব সময় হাতে পাওয়া খবরে সবচেয়ে কম সংখ্যাটি বিবেচনায় নেয়।
কোনও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সেখানকার পূর্ণ চিত্র পাওয়া অসম্ভব। কারণ, যুদ্ধরত পক্ষগুলো সবসময় নিজেদের পক্ষে প্রচার চালায়। সাংবাদিকদেরও যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে দেওয়া হয় না।
মিয়ানমারে সংঘাত কীভাবে রূপ বদলেছে?
১. ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় এবং সেনাবাহিনীও রক্তক্ষয়ী দমনাভিযান শুরু করে।
৩. সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে দূর নিয়ন্ত্রিত সহিংসতা- যেমন: বোমা, বিস্ফোরক এবং স্থলমাইন হামলা বেড়েছে।
সংঘাত আরও প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে-
পিডিএফ যোদ্ধা কারা:
সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নিয়ে পিডিএফ গঠিত হয়েছে। সেখানে যেমন আছেন চিকিৎসক ও প্রকৌশলী তেমন আছেন কৃষক ও গৃহিনীরা। তারা জান্তাশাসকদের উৎখাত করতে এক হয়ে লড়াই করছেন। পুরো মিয়ানমারের মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ।
তবে এবার আদিবাসী ‘বামার’ জনগোষ্ঠীর তরুণদের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। আদিবাসী সংখ্যাগুরু বামার তরুণরা সমভূমি ও নগরীগুলোতে অন্যান্য আদিবাসী তরুণদের সঙ্গে বিভিন্ন বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে এবং যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে।
মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এবারই প্রথম সেনাবাহিনী বামারদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। মিশেল ব্যাশেলে বিবিসি-কে বলেন, “অনেক বেসামরিক নাগরিক এসব মিলিশিয়া বা কথিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সে যোগ দিচ্ছে।
“তাই অনেকদিন ধরেই আমি বলছি, যদি আমরা আরও কঠোর হাতে কিছু করতে না পারি তাহলে এটা আসলে সিরিয়া পরিস্থিতির মত হবে।” সেন্ট্রাল মিয়ানমারের সাগাইং রাজ্যের নাগার একসময় ব্যবসা করতেন। তিনি এখন ওই অঞ্চলে পিডিএফের কয়েকটি ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করেন। বিবিসি-কে তিনি বলেন, এটা সমানে সমানে লড়াই নয়।
“পিডিএফ শুধুমাত্র গুলতি হাতে এই লড়াই শুরু করেছে। এখন তারা নিজেদের জন্য বন্দুক এবং বোমা বানাচ্ছে। অথচ ভারি অস্ত্র সজ্জিত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গত কয়েক মাসে বিমান হামলা চালিয়েছে। তারা রাশিয়া ও চীনের মত দেশ যারা তাদের সমর্থন করছে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে পারছে।”
মিয়ানমারের প্রত্যক্ষদর্শী ও বিবিসি-র একটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কয়েক সপ্তাহ আগে ইয়াংগনে রুশ সাঁজোয়াযান পৌঁছেছে।
কিন্তু পিডিএফ-র মূল শক্তি তাদের প্রতি স্থানীয় মানুষদের সমর্থন। তাই একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু হওয়া প্রতিরোধ এখন অনেক বেশি সুসংগঠিত, সাহসী এবং যুদ্ধ করতে সক্ষম। নির্বাসিত জাতীয় ঐক্যের সরকারও তাদের সহায়তা করেছে এবং পিডিএফ-র কয়েকটি ইউনিটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর অনানুষ্ঠানিকভাবে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগও রাখছে।
পিডিএফ-র লক্ষ্য সরকারি বাহিনী, যেমন পুলিশ স্টেশন বা কম লোকবলের চৌকিগুলো। তারা অস্ত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে এবং সামরিক জান্তার মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বোমা মারছে। এর মধ্যে আছে টেলিকম টাওয়ার ও ব্যাংক।
নাগার বলছেন, দেশটির ভবিষ্যৎ নিজেদের হাতে নেওয়া ছাড়া পিডিএফ-র সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই। তিনি বলেন, “আমি মনে করি আলোচনায় আর সমাধান হবে না। বিশ্ব আমাদের দেশকে উপেক্ষা করছে। সেজন্যই আমি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছি।”
অন্য বোনেদের নিয়ে পিডিএফ এ যোগ দেওয়া হেরা বলেছেন, তাদের লক্ষ্য সামরিক স্বৈরাচারকে উৎখাত করা। হেরা বলেন, ‘‘সেনাবাহিনী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। তারা মানুষের জান-মাল ধ্বংস করছে এবং তারা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এটা আমি মেনে নিতে পারছি না।’’
বিবিসি জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে গণহত্যার বেশ কয়েটি ঘটনা ঘটেছে। গত জুলাইতে অন্তত ৪০ জন এবং ডিসেম্বরে নারী ও শিশুসহ ৩৫ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
এমন ঘটনায় বেঁচে আসা একজনের সাথে বিবিসি’র সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, নাগাথিন এলাকার একটি গ্রামে সেনাবাহিনী প্রবেশের পর পালাতে না পারা ছয় জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন বয়স্ক আর দুজন ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন।
গৃহযুদ্ধে আটকে পড়া পরিবার:
সংঘাতের নিহত এক ব্যক্তির স্ত্রী বিবিসি-কে বলেন, তার স্বামীর মৃতদেহে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। ২০২১ সালের শেষের দিকে জান্তা বাহিনীর মুখপাত্র জ মিন তুন বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পিডিএফ-কে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, ‘‘তারা যদি আমাদের ওপর আক্রমণ করে, আমরা সেনাদেরকে এর উপযুক্ত জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়ে রেখেছি। আমরা দেশকে এবং অঞ্চলকে সুরক্ষা দিতে সচেষ্ট। যৌক্তিক পর্যায়ে নিরাপত্তা বিধান করতে আমরা যথোপযুক্ত শক্তি প্রয়োগ করছি।’’
মিয়ানমারে কোন পক্ষে কত জন লড়াই করছে তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। দেশটির সেনাবাহিনীতে আনুষ্ঠানিক সদস্য তিন লাখ ৭০ হাজার। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক কম হতে পারে। গত কয়েক বছরে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ তেমন একটা হয়নি। তাছাড়া অভ্যুত্থানের পর অনেকে পক্ষত্যাগও করেছেন। একইভাবে পিডিএফ এর সদস্য সংখ্যারও সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন।
পাশাপাশি এনইউজি-র গঠন করা ইউনিটগুলো ছাড়াও সীমান্তে কার্যক্রম পরিচালনা করা জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে কিছু পিডিএফ সদস্য প্রশিক্ষণ, আশ্রয় এবং এমনকী অস্ত্রশস্ত্রও পেয়েছে। কিছু কিছু গোষ্ঠী পূর্ববর্তী সরকারের সাথে অস্ত্র বিরতি চুক্তিও করেছিল, যে চুক্তিগুলো এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
